
দেশের মধ্যাঞ্চলের শত বছর ধরে আড়িয়ল বিলে কুমড়াই সমৃদ্ধি লাখ লাখ মানুষের।
রুবেল ইসলাম তাহমিদ,মুন্সীগঞ্জ আড়িয়ল বিল থেকে ফিরে।
বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী দিগন্ত জোড়ে জেগে উঠা সবুজের বুক চিরে টলটলে নদী খালের পানির প্রশস্ত বছরে জুরেই। চলে ইঞ্জিনবোটের ফটফট সব্দে সারা দিন। যেনো সে শব্দেই জেগে থাকে ঐতিহ্যবাহী আড়িয়ল বিল। কিন্তু কৃত্রিম সে শব্দকে উপেক্ষা করে এখানে ঋতুভিত্তিক সৌন্দর্য ফুটে থাকে। বর্ষায় শাপলা’” বৈশাখে ধান-ভাদ্র তে কুমড়া এছাড়াও নানা সবজি। প্রকৃতি ধরা দেয় তার আপন চেহারায় বিলের শো-শো বাতাস- শীতে পত্র পল্লবহীন গাছেও ’পাখিদের কিচিরমিচির আর আর্দ্র মাটির বুকে সবুজে আবরণ প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার সাধ. বিল জুড়ে জালের মতো ছিটিয়ে রয়েছে ছোট ছোট খাল। শুকনো মৌসুমে এই খালগুলোই বিলের আশীর্বাদ। এমনও শোনা গেছে একেকটি কুমড়ার ওজন ৪ মণেরও বেশি বেশি হয় এখানে।বর্ষায় বিল ভরা মাছ , শুষ্ক মৌসুমে কুমড়া, শসা, আর নানা জাতের সবজি। আর হয় ধানের চাষ। সব মিলিয়ে প্রকৃতির এক ভাণ্ডার এই বিল।

মুন্সিগঞ্জ জেলার ৯৪৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ১৩৬ বর্গ কিলোমিটার এই আড়িয়ল বিল। দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটারের বেশি এবং প্রস্থ প্রায় ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। একদিকে পদ্মা নদী অন্যদিকে ধলেশ্বরী। তারই মাঝখানে এক বিপুল অবভূমি এই বিল।দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রাচীন জলাশয়। বর্ষায় বিশাল এই বিল পানিতে থাকে টইটুম্বর। শীতকালে এটি হয়ে ওঠে শীর্ণ-শুষ্ক। বিল রূপ নেয় ফসলের মাঠে তা প্রতি বছর। চারো দিকে যতদূর দেখা যায় দিগন্ত জোড়া বিস্তীর্ণ শস্য খেত প্রধানত ধান, সরিষা আর কুমড়ার চাষ সহ আরো অনেক শস্য হয় এই বিলে। বিলের মাঠ থেকেই তোলা হয় বিপুল আকার কুমড়া। বলা হয়, এই বিলের কুমড়ার আকারই সবচেয়ে বড়।দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শত বছর ধরে আড়িয়ল বিলে কুমড়াই সমৃদ্ধি।
বর্ষায় খালগুলো মিলে যায় পানির তোড়ে। তখন বিল জুড়ে থৈ থৈ জল। কিন্তু শীতে শুষ্ক মৌসুমে এই খালই ভরসা-খালই বিলের প্রাণ। প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট আড়িয়ল বিলে ভাগ্য গড়ে, জীবিকা চলে এখানকার লক্ষ মানুষের।

শ্যামসিদ্ধি ইউনিয়নের, সেলিম রেজা, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে শুষ্ক মৌসুমে এই বিলে কুমড়ার চাষ করে নিজের ভাগ্য বদলেছেন। সন্তানদের ভালো ভবিষ্যৎ গড়তে এখনো বিলের কাদা গায়ে মেখে দিনভর খাটেন তিনি। সেলিমের মত আরেক কৃষক রবিউল ইসলাম। এ বিলের পানি ও মাটির সাথে তার সকল সখ্য। এখানে চাষ করে অভাব ঘুচেছে সংসারের। বিদেশ পাঠিয়েছে দুই ছেলে। সেলিম ও নূরুল ইসলামের মতো আরও অনেক কৃষকের সাথে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন প্রত্যেকের ভাগ্য বদলের পিছনে আছে প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট আড়িয়ল বিল। বিশেষ করে এ বিলে চাষ করা কুমড়াই এসব মানুষের ভাগ্য বদলের রহস্য।
মো. সেলিম – বলেন, “বোঝার বয়স থেকে আড়িয়াল বিলে খাইটা খাই। দাদা করে গেছেন, বাবা করেছেন, এখন আমি করি। সেই একই কাজ- কুমড়ার চাষ করি। এবারও আল্লাহর রহমতে ২-৩ লাখ টাকার কুমড়া বেচমু। লাউ আছে কিছু জমিতে। সেগুলো উঠামু।” এবার একটু দাম কম এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, “দিন দিন ফলনও কমতেছে। তবে তাও যা ফলে সংসার চইলা যায়। ছেলে মেয়ে বড় হইছে। যা হয় দু:খ নাই । ভালোই চলছে। নুরুল ইসলাম বলেন, ছোটবেলা থেকে এ বিলে পইড়া আছি। “এবার কানি পাঁচেক জমি চাষ করছি ইরি ধান। ৪-৫শ মন ধান আল্লাহ দিতে পারে। কুমড়া বেচমু কয়েক লাখ টাকার। আমার পরিবারে ছেলে মেয়ে আমরা দুইজন নাতি নাতনি মিলে ১২জন। সবার খরচ এই চাষ থেকে চলে। পোলারা দেশের বাইরে গেছে আল্লাহ দিলে ভালোই চলছে দিন। আরেক কৃষক আব্দুল গনি জানালেন, এই বিলে তাদের ভাগ্য বদলেছে। “বর্ষায় মাছ, শুষ্ক মৌসুমে ধান, সরিষা, কুমড়ার চাষ” শাপলা আমাদের ভাগ্য বদল করেছে ।” কয়েক লাখ মানুষ এই বিলে খেটে বাচে। এই অঞ্চলের মানুষ আগে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করত। বিল পারি দিয়ে দিনে অন্যত্র কাজে যেত আর অনেক রাতে ফিরে আসত বাড়ি। কিন্তু অনেকের জন্যই এখন সেই দিন গত হয়েছে। এই বিলে চাষাবাদ ও তা থেকে উৎপাদন হওয়ার পর থেকে এখন অনেকেরই জীবনে সচ্ছলতা ফিরে পেয়েছে। বিলে চাষাবাদ করে আয় করা অর্থে অনেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন সন্তানদের। আর সেই বিদেশ থেকে আসা অর্থে তাদের বড় বড় ব্যবসা হয়েছে। বড় বড় বাড়ি হয়েছে। কুমড়া মানুষের দুঃখ ঘুচাইছে এখন আল্লাহ দিলে অনেক চাষ হয়। নতুন করে শাপলা চাষ হচ্ছে। তাতেও অনেক মানুষের বেকারত্ব ঘুচেছে। জীবিকা হয়েছে। আমরা আরিয়াল বিলকে আশির্বাদ মনে করি,” বলেন আব্দুল গনি। চাষপদ্ধতি নিয়ে জানতে চাইলে চাষিরা জানান, বর্ষা মৌসুমে টইটুম্বুর পানিতে আড়িয়াল বিল দখল করে কচুরিপানা। পানি কমলে সেই কচুরিপানা দিয়েই তারা ভিটা তৈরি করেন। এমন একেকটি ভিটা তৈরিতে খরচ হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা।

পরে রোদের তাপে কচুরি পানা পচে শুকিয়ে মিশে যায় মাটির সাথে। ততদিনে ভাদ্র মাস হাতছানি দেয় প্রকৃতিতে। মিষ্টি রোদের ঝলমলে পরিবেশে কুমড়ার বীজ বোনা হয়। শুরু হয় ভাদ্র থেকেই। শেষ হয় কার্তিক মাসে। কথা হয় এখানকার বাসিন্দা লেখক জাকির হোসেনে সহ অনেকেরই সাথে,কেউ কেউ শোনালেন সবচেয়ে বড় কুমড়ার জাত চৈতালির কথা। বললেন, আড়িয়ল বিলে একসময় শুধু চৈতালি জাতের বড় আকারের কুমড়ার চাষই হতো। তবে এত বড় কুমড়া খুচরা বাজারে বিক্রি অপেক্ষাকৃত দুষ্কর। এ কারণে ব্যবসায়িক মন্দা দেখা যেতো। তাছাড়া রয়েছে ইঁদুরের উৎপাত। একটি বড় কুমড়া ইঁদুর কাটলে গোটাটাই নষ্ট হয়ে যায়। এসব কারণে চৈতালীর কদর এখন কিছুটা কম। এখন বিভিন্ন জাতের কুমড়ার চাষ হয় এখানে। বিশেষ করে হাইব্রিড জাতের কুমড়া চাষে আগ্রহ বেশি কৃষকদের। কারণ এর ফলন বেশি। ইন্দোনেশিয়ান বেঙ্গল টু ,মল্লিকা-১, লাল তীরসহ বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের কুমড়ার বীজ রোপন করেন কৃষকরা। ঢাকার সিদ্দিক বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয় বীজ। কার্তিক মাসে বীজ রোপণের পর থেকেই শুরু হয় পরিচর্যা। এরপর বীজ ফুটে গাছ হয়। বাড়তি পরিচর্যায় গাছ বড় হতে থাকে। আর পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত গাছগুলোয় কুমড়া ফলতে থাকে। যা বাজারজাত করা হয়। আড়িয়ল বিলের কুমড়ার কদর আছে ক্রেতাদের কাছে। তাই নামেও চলে অনেক কুমড়া। আর স্বাদেও তা সেরা।ঐতিহ্য ধরে রাখতে কেউ কেউ এখনো বাণিজ্যিকভাবে চৈতালির চাষ করেন। সৌখিন চাষীরাই বেশি করেন। তবে সে সংখ্যা এখন অনেক কম। বাজারজাত করারও রয়েছে বিশেষ কৌশল। বিস্তৃত খেত থেকে কুমড়া কেটে নৌকা করে খাল বেয়ে নেওয়া হয় বিলের ঘাটে। সেখান থেকে ছোট বড় নৌকার ওপরেই গাদি ঘাটে বড় ব্রিজের সাথে সাজানো হয় কুমড়ার পসরা। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে তা নিলামে উঠে। দর হাঁকে কৃষক। দর কষাকষির এক পর্যায়ে নির্ধারণ হয় কুমড়ার কাদির দাম। এর পর ট্রাকে উঠানো হয় কুমড়া। শুরু হয় কুমড়ার বাণিজ্যিক যাত্রা। আগে ঢাকার শ্যামবাজারে কুমড়া গুলো বিক্রি হলেও এখন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কেজি হিসেবে বিক্রি হয়।

মাজের হাটি গ্রামে নাজির- নামের একজন কৃষক জানালেন, আগে কুমড়া বাজারজাত করতে শুধু নদী পথ ব্যবহার হতো। ছোট ছোট নৌকা ও ট্রলারে কুমড়া উঠিয়ে নেওয়া হতো গাদি ঘাটে। সেখান থেকে আবার নদী পথে শ্যামবাজার যেত। এরপর দেশের বিভিন্ন বাজারে মিলত আড়িয়াল বিলের সকল প্রকার কুমড়া। এক দিকে যেমন কদর কমেছে চৈতালি জাতের কুমড়ার । অন্যদিকে সক্ষমতাও কমেছে আড়িয়ল বিলের চাষাবাদের। তা ছাড়া খণনের অভাবে বিলের খালগুলোও হয়ে পড়ে পানিশুণ্য। কৃষকদের অভিযোগ, রাস্তাঘাট না থাকায় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পণ্য আনা নেওয়া করতে হয়। এতে ভোগান্তির শেষ নেই।
এছাড়া কৃষি অধিদফতরের আওতাধীন সুযোগ সুবিধাও পান না এখানকার কৃষকরা।
গাদি ঘাট এলাকায় কথা হয় কৃষক আবু বক্করের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা বারো মাসই কষ্ট করি। মোবাইলে অনেক খবর দেখি সহযোগিতা পায় সবাই। আমরা তো পাইনা । এখানে রাস্তা না থাকায় আমাদের চলাচলে কষ্ট। ধান কুমড়া আনা নেওয়ায় অনেক কষ্ট করতে হয়। আমাদের দাবি এখানে উন্নত প্রযুক্তি আসুক খাল গুলো খনন করা হোক । একই এলাকার সিরাজুল ইসলাম বলেন, কৃষি কর্মকর্তাদের দেখা যায় না এ দিকে। কোন সহযোগিতা পাই না আমরা। বিলের কৃষিভিত্তিক আধুনিক প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানালেন তিনি। ২৬ মাইল দৈর্ঘ্য এবং ১০ মাইল প্রস্থের এ জলাভূমির আয়তন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর। শ্রীনগর, নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৭০টি গ্রাম নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে আড়িয়ল সভ্যতা ও এর জীবনধারা।

তিনটি উপজেলার মধ্যে শ্রীনগরে রয়েছে ৮টি ইউনিয়ন, ভাগ্যকূল ইউনিয়নের জগন্নাথপট্টি ও কামারগাঁও মৌজা, বাঘড়া ইউনিয়নের পূর্ব মৌড়া মৌজা, শ্যামসিদ্ধি ইউনিয়নের মত্তগ্রাম ও গাদিঘাট মৌজা, শ্রীনগর ইউনিয়নের দয়হাটা মৌজা, ষোলঘর ইউনিয়নের বিল আড়িয়ল ও ষোলঘর মৌজা, বাড়ৈখালী ইউনিয়নের বাড়ৈখালী, বিল আরৈ, শ্রীধরপুর, দাসের চক ও পূর্ব মরিচপট্টি মৌজা, হাঁসাড়া ইউনিয়নের আলমপুর, লস্করপুর ও হাঁসাড়া মৌজা, রাঢ়ীখাল ইউনিয়নের রাঢ়ীখাল ও মাইজপাড়া মৌজা; দোহার উপজেলার মধ্যে রয়েছে ৪টি ইউনিয়ন,নারিশা ইউনিয়নের হাঁসী,ঝনকী ও শিমুলিয়া মৌজা, সুতার পাড়া ইউনিয়নের ঘাটা, সুতার পাড়া, দামুয়া ও মুন্সিকান্দা মৌজা, মুকসুদপুর ইউনিয়নের পশ্চিম মোড়া মৌজা, রাইপাড়া ইউনিয়নের লস্কর কান্দা ও ইউসুফপুর মৌজা; নবাবগঞ্জ উপজেলার মধ্যে রয়েছে ৪টি ইউনিয়ন, বক্সনগর ইউনিয়নের বড় বক্সনগর, ছোট জাফরপুর, দীঘিড়পাড়, টুকনিকান্দা, ছোট বক্সনগর, বর্দ্ধন পাড়া ও কোমরগঞ্জ মৌজা, চূড়াইন ইউনিয়নের বড় গোবিন্দপুর, দুর্গাপুর, চূড়াইন, তিলখোলা, কামারখোলা, মনসুরনগর, সেরাজুদ্দীনপুর ও পশ্চিম মরিচপট্টি মৌজা, গালিমপুর ইউনিয়নের সুরগাঁও ও গালিমপুর মৌজা, কলাকোপা ইউনিয়নের বড় জাফরপুর ও বারৈখোলা মৌজা। এ বিলকে ঘিরে চার থানার ১০ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা চলে। শত শত বছর ধরে বিলে বসবাস করছে এ অঞ্চলের আধিবাসী।
